ভ্যাটে দাম বাড়বে এলপি গ্যাসের
LP |
১ জুলাই থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট আইন কার্যকর হলে দাম বাড়বে এলপি গ্যাসের। ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে বিক্রয় মূল্যের ভিত্তিতে নতুন হিসাব শুরু হলে এ খাতে ভ্যাটের পরিমাণ সিলিন্ডারের আকার ভেদে ১ হাজার ২৮ শতাংশ থেকে ১ হাজার ৫৮৯ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফলে এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীদের সিলিন্ডার ভেদে ৫৪ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় বহন করতে হবে। এ অবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় এলপি গ্যাসের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি চান ব্যবহারকারী ও উদ্যোক্তারা। বাড়তি ভ্যাট আরোপের ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় ২০১৯ সালের মধ্যে আবাসিক ও পরিবহন কাজে ৭০ শতাংশ গ্রাহকের কাছে এলপি গ্যাস সরবরাহে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ একেবারেই অপ্রতুল। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের জন্য এই গ্যাস প্রয়োজন। সরকার বাসা-বাড়ি ও হোটেল- রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ দিচ্ছে না। এসব খাতসহ শিল্প খাতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু বাড়তি ভ্যাটের কারণে দাম বাড়লে এলপি গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহে ভাটা পড়বে। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে সরকারের চেষ্টা ব্যাহত হবে। এলপি গ্যাস নিয়ে সরকারের উদ্যোগ সফল করতে এ খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে এলপিজি ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে সরকারের এ ভর্তুকি সাশ্রয় হবে। ভোক্তা ও প্রান্তিক মানুষের পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় সরকারকে বাজেট পাসের সময় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জানা গেছে, ব্যবহার উৎসাহিত করে পাইপলাইনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ওপর চাপ কমাতে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাসের ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। বর্তমানে এ খাতে ভ্যাটের হার ট্যারিফ মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ। এর ফলে বাজারে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকায় এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাসসহ সবপণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এলপি গ্যাসকে অব্যাহতির তালিকায় না রাখা এবং সার্বজনীন ভ্যাট হার কার্যকর হওয়ায় সব আকারের বাসাবাড়ি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে ব্যবহূত এলপি গ্যাসের দাম বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের অর্থ ও হিসাব বিভাগের প্রধান মাহবুব আলম বলেন, সরকার এলপি গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এলপি গ্যাসে ভ্যাটের হার বেড়ে যাওয়ায় এ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যাবে। কারণ দাম বাড়লে এলপিজির ব্যবহার জনপ্রিয় করতে সরকারের সব কার্যক্রম ব্যাহত হবে। জানা গেছে, শুধু রান্নার কাজেই নয়, বর্তমানে গাড়ি চালানো, ক্ষুদ্র শিল্পের জ্বালানি এবং রাসায়নিক ও প্রসেসিং কারখানার কাঁচামাল হিসেবেও এলপি গ্যাস ব্যবহূত হচ্ছে। এমনকি অনেক বড় ও মাঝারি শিল্প-কারখানাও এই গ্যাসে চলছে। কিন্তু পাইপলাইনের গ্যাসের চেয়ে দাম বেশি হওয়ায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার প্রত্যাশামতো বাড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘সরকার আবাসিক খাতে পাইপলাইনের গ্যাস সরবরাহ থেকে সরে আসছে। রান্নার কাজে গ্যাসের ব্যবহার পুরোপুরি এলপিজিনির্ভর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাস সহজলভ্য করার চেষ্টা চলছে। ’ জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রান্নার কাজে পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহার করেন—যা দেশের মোট পরিবারের মাত্র ৭ শতাংশ। বাকি ৯৩ শতাংশ পরিবার এ সুবিধা পাচ্ছে না। তাদের জন্য বিকল্প জ্বালানি হতে পারে এলপি গ্যাস। কিন্তু দাম সহনীয় না থাকলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ পরিবার তা ব্যবহার করতে পারছে না।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভ্যাট নির্ধারণে বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৫ থেকে ১০ কেজি আকারের সিলিন্ডারের ট্যারিফ মূল্য ধরা হয় ৩৫ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হয় ৫ টাকা ২৫ পয়সা। ভ্যাট ছাড়া এই আকারের প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের বিক্রয় মূল্য ৩৯৭ টাকা ৭৫ পয়সা। ভ্যাটসহ ব্যবহারকারীদের কাছে এই সিলিন্ডার ৪০০ টাকায় সরবরাহ করা হয়। একইভাবে বর্তমানে ১১ থেকে ৩০ কেজি আকারের সিলিন্ডারে ৯ টাকা ভ্যাটসহ সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ৮৯৭ টাকা। ৩১ থেকে ৪৫ কেজির সিলিন্ডারে ভ্যাট ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। এই সিলিন্ডারের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ২ হাজার ১৩০ টাকা। অন্যদিকে নতুন পদ্ধতিতে বিক্রয় মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের ফলে ৫ থেকে ১০ কেজি আকারের সিলিন্ডারে ভ্যাট আদায় করা হবে ৩১৬ টাকা ৬৯ পয়সা। এতে এই সিলিন্ডারের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ৪৫৪ টাকা— যা বর্তমানের তুলনায় ৫৪ টাকা বেশি। একইভাবে নতুন হারে ১১ থেকে থেকে ৩০ কেজি আকারের সিলিন্ডারে ভ্যাট ১৩৩ টাকা ২০ পয়সা এবং সরবরাহ মূল্য ১ হাজার ২১ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়াবে। যা বর্তমানের তুলনায় ১২৪ টাকা বেশি। ৩১ থেকে ৪৫ কেজি আকারের সিলিন্ডারে ভ্যাট ৩১৬ টাকা ৬৯ পয়সা ও সরবরাহ মূল্য ২ হাজার ৪২৭ টাকা ৯৪ পয়সায় দাঁড়াবে। এই আকারের সিলিন্ডারে দাম বাড়বে প্রায় ৩০০ টাকা। জানা গেছে, ব্যাপক চাহিদা থাকলেও প্রাকৃতিক গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় দেশের জেলা শহর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত গৃহস্থালী ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা হয়। আবাসিক ভবনে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখায় গত কয়েক বছরে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতেও রান্নার কাজে এলপিজির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এলপি গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১০ লাখ টন। এর বিপরীতে বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে ৫ লাখ টন। এলপি গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এলপিজি বোতলীকরণ প্লান্ট স্থাপন পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সরকার বিভিন্ন উপকরণের আমদানি পর্যায়ে কর অব্যাহতি প্রদান ও রেয়াতি হারে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। ফলে বিপিসির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান এলপিজি প্লান্ট স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে। জানা গেছে, ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও গ্যাস ও সিলিন্ডারের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে এলপি গ্যাস ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই তারা রান্নার কাজে কেরোসিনসহ জ্বালানি তেল ও কাঠ ব্যবহার করছে। এতে একদিকে জ্বালানি খাতে সরকারকে অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। এ অবস্থায় ভ্যাটের নতুন নিয়মের ফলে দাম বাড়লে এলপি গ্যাসের ব্যবহার নিরুৎসাহিত হবে। ফলে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস সরবরাহে সরকারের উদ্যোগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সীমিত হওয়ায় পাইপলাইনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। এ কারণে আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। শিল্প খাতেও গ্যাসের সংযোগ সীমিত করা হয়েছে। পরিবহন খাতে সিএনজির (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এলপি গ্যাস। ২০১৯ সালের মধ্যে গৃহস্থালী জ্বালানি চাহিদার ৭০ শতাংশ এলপি গ্যাস দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কিন্তু দাম সহনীয় রাখতে না পারলে সাধারণ মানুষের কাছে এই গ্যাসের ব্যবহার জনপ্রিয় হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এলপি গ্যাসের আওতায় আনতে সরকারের নীতি ও কর ব্যবস্থা সহনীয় করা উচিত। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে এলপিজিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তান ও নেপালে গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় বাংলাদেশেও এ খাতে ভর্তুকিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তা না করে উল্টো ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ জ্বালানি খাতে সরকারের সামগ্রিক উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ বাজেটে অত্যাবশ্যকীয় অনেক পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীরা এই সুবিধা পাচ্ছে না। নতুন ভ্যাটের কারণে দাম বাড়লে সামগ্রিকভাবে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
No comments
Post a Comment