Header Ads

ঈদ আসছে কান্না নিয়ে /হাওরাঞ্চল থেকে

ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তার চোখ ছলছল করে ওঠে। একপর্যায়ে কান্না আর বাঁধ দিয়ে রাখতে পারলেন না। অবশ্য এ প্রশ্ন করার আগে আরও অনেক কিছু নিয়েই কথা হয়েছে সরমঙ্গল হাওরের চণ্ডীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. শাহজাহানের সঙ্গে। তিন ভাই মিলে ১৯ সদস্যের যৌথ পরিবারের প্রধান শাহজাহান। জমিজমা যা আছে, ঘরে ফসল তুলতে পারলে এখন কমপক্ষে ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ মণ ধান থাকত তাদের গোলায়। যাদের গোলাভরা ধান ও হাওরভরা মাছ আছে, তাদের আর ভাবনা কী? সাধারণত এ সময় হাওরের বাতাসে ভাসে গানের সুর। বাড়ি বাড়ি বসে কিস্সা পালার আসর।

বর্ষা পুরোপুরি আসতে বাকি আছে আরও কিছুদিন। বর্ষা আসার আগেই হাওর ভাসে বানের জলে। তবে এবার বান এসেছে অকালে। গত ২৭ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামতে শুরু হয়। এর পর একের পর এক ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওরের বোরো ধান। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, সুনামগঞ্জে এবার ১৫৪টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে এক লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা তিন লাখ ২৫ হাজার ৯৯০। এর মধ্যে বিশেষ ভিজিএফ পাচ্ছে দেড় লাখ পরিবার। বাকি প্রায় পৌনে দুই লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখনও ত্রাণ সহায়তার বাইরে রয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বেশিরভাগ হাওরের ধান নষ্ট হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সব জেলা মিলিয়ে প্রায় এক কোটি হাওরবাসী শিকার হয়েছে ফসলহানির।
বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে ভাসা হাওরের আর সব কৃষকের মতো শাহজাহানও মাঠ থেকে একমুঠো ধান ঘরে তুলতে পারেননি। শাহজাহানদের বড় একটা নৌকা আছে। ইঞ্জিনচালিত এই নৌকায় ধান-চাল বহন করে মৌসুমে তাদের তিন ভাইয়ের লাখ পাঁচেক টাকা আয় হতো। মাঠের ধান ভেসে যাওয়ার পর শাহজাহানের ছোট দুই ভাই শাহ কামাল ও আবুল খায়ের চলে গেছেন ঢাকায়। তারা এখন গার্মেন্টে চাকরি করছেন। শাহজাহানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের মধ্যে সবার বড় তামান্না আক্তার পড়ছে দশম শ্রেণিতে ব্র্যাক পরিচালিত আলোর দিশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
গত বুধবার শাহজাহানের সঙ্গে আলাপ হয় এই আলোর দিশারী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে দিরাই সদর। দিরাই বাজারের পুলের ঘাট থেকে নৌকায় কালনী নদী ধরে ঢাকা থেকে যাওয়া তিন সাংবাদিকের একটি দল দুই কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পর হাওরের দেখা পাই। হাওরের ভেতরে আরও প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে আলোর দিশারী স্কুলটির অবস্থান। কৃষকের ঘরে ধান নেই বলে এবার নৌকায় মালামাল বহনের মতো কোনো কাজও নেই। শাহজাহান তাই আলোর দিশারী বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়ার কাজে নিজের নৌকাটি ভাড়া দিয়েছেন। নৌকার মাঝি তিনি নিজেই। বিনিময়ে দৈনিক পাচ্ছেন ৮০০ টাকা। এর মধ্যে অর্ধেকের মতো টাকা চলে যায় নৌকার তেল খরচ বাবদ। ১৯ জনের পরিবার চালাতে বাকি টাকা খরচ হচ্ছে। বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচই চালাতে পারছেন না। তাই ঈদে এবার ওদের কাউকে কিছু দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।
শাহজাহানের সঙ্গে আলাপের সময় সেখানে এলো তার মেয়ে তামান্না আক্তার। জানাল, গেল বছর ঈদে সে নিজে পেয়েছিল 'পাখি জামা', যার দাম পড়েছিল সাড়ে ৭০০ টাকা। তার যে ভাইটা মাদ্রাসায় পড়ে, সে নিয়েছিল পাজামা-পাঞ্জাবির সেট। অন্য ভাইদের দেওয়া হয়েছিল প্যান্ট ও শার্ট। ছোট বোন পেয়েছিল থ্রিপিস। মা শাড়ি। বাবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। সঙ্গী দুই সাংবাদিকের একজন তামান্নার কাছে জানতে চাইলেন, 'এবার ঈদে বাবার কাছে কী উপহার চাও তুমি?' তামান্নার কণ্ঠে বিস্ময়, 'ভাতই খেতে পাচ্ছি না, উপহার চাইব?' তবু নাছোড় সাংবাদিকের প্রশ্ন, 'ধর, তোমার বাবা কোনোভাবে কিছু টাকা পেয়ে গেলেন এবং তোমাকে কিছু দিতে চাইলেন, তাহলে?' তামান্না বলল, 'তাহলে আমি ওই টাকায় কিছু খাতা-কলম কিনব।'
আলোর দিশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মঈন উদ্দীন বললেন, তামান্না তার ভালো ছাত্রছাত্রীদের একজন। এবারই প্রথম তাদের স্কুল থেকে ৩৭ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। যারা এসএসসিতে অংশগ্রহণ করবে, জেএসসিতে তারা শতভাগ পাস করেছিল। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে উদগল নামে পরিচিত সরমঙ্গল ও সংলগ্ন এলাকার এই হাওরের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় এটি। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে আশপাশের গ্রামে অষ্টম শ্রেণি পাস মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। তিনি এই হাওরের চণ্ডীপুর গ্রামের বাসিন্দা, যিনি কি-না এই এলাকার প্রথম অনার্স ও মাস্টার্স পাস মানুষ। আলোর দিশারী স্কুল ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে এলাকায়। অভিভাবকরা চেষ্টা করছেন বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতে। তবে এবারের অকাল বন্যায় আতঙ্কিত তারা। বৈশাখে নতুন ধান ঘরে উঠলে তারা সামনের একটা বছরের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। ধান শুধু তাদের ভাত জোগায় না, গরুর খাবারও জোগায়, রান্নার জ্বালানিও হয়। সেই ধানই নেই। তাদের পাড়ার মসজিদে কে কখন ইফতারি দেবে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। এবার রমজানের ১১ দিনে মাত্র একবার মসজিদে ইফতারের আয়োজন হয়েছে।
বুধবার মঈন উদ্দীনের সঙ্গে যখন আলাপ হয়, সেদিন ছিল রমজানের ১২ তারিখ। পরদিন বৃহস্পতিবার যাওয়া হয় দিরাইয়ের আরেক হাওর উজানধলে। বাউলসম্রাট নামে খ্যাত শাহ আবদুল করিমের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়াতেই এগিয়ে আসেন বাবড়ি চুল দোলানো এক যুবক। তার নাম দুখু মিয়া। দুখু বললেন, 'আমি বাউল আবদুল করিমের ভাগি্ন ঘর্র নাতি। হুড়ূবেলায় (ছোটবেলায়) মা-বাপ হারানির ফরে তাইন আমার নাম দিছলাইন দুখু মিয়া। তাইন কইতাইন কবি নজরুলের নামও আছিন দুখু মিয়া।'
দুখু মিয়ার সঙ্গে আলাপ শুরু হতেই সেখানে এলেন বাউল করিমের শিষ্য আবদুল কাইউম। করিমের ছেলে শাহ নূরজালাল আছেন কি-না জানতে চাইলে তারা বলেন, 'ঘুমাইতাছুইন (ঘুমাচ্ছেন)। রাইতে তারাবির ফরে গানের আসর বইছিল। শেষ অইছিল ফতার (সেহরির) আগে। ফতা খাইয়া ঘুমাইতে গেছুইন।' এরই মধ্যে খবর পেয়ে এলেন শাহ নূরজালাল। বললেন, 'ফসল তোলার পর গানের মহোৎসব লেগে যায় হাওরে। রোজার মাসেও তারাবির পর থেকে সেহরি পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে বসত গানের আসর। বর্ষায় ঈদ হলে ঈদের পরদিন থেকে টানা ক'দিন হাওরের সর্বত্র শোনা যায় গান, যাত্রা ও পালার সুর। কিন্তু এবার বর্ষায় কোথাও কোনো ডাক পাননি তারা। ঈদের পর যে পাবেন, এমন ভরসাও নেই। হাওরে এবার ঈদ আসছে কান্না নিয়ে।'
হাওরের সর্বত্রই এই চিত্র পাওয়া গেছে বলে সমকালের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। হাওরের রানী সুনামগঞ্জ শহরে গত শনিবার সমকালের সঙ্গে কথা হয় সুনামগঞ্জ শহরের সবচেয়ে বড় টেইলারিং শপ ক্যামেলিয়া টেইলার্সের ব্যবস্থাপক মুহিত মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'অন্যান্য বছর রমজানের পহেলা সপ্তাহের পর শহরের পরিচিতজনদের বিশেষ অনুরোধে দু-একটা নতুন অর্ডার নেওয়া হতো। এবার যে অবস্থা, তা থেকে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে ঈদের আগে আগেও নতুন অর্ডার নেওয়া যাবে।' শহরের পৌর বিপণিতে অবস্থিত মোহাম্মদীয়া পাঞ্জাবি টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ফারুক বলেন, 'কাজ নেই। চাইলে এখনও সকালে অর্ডার দিয়ে বিকেলে ডেলিভারি নিতে পারবেন।'
সুনামগঞ্জেরই জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার হাওরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। সেই বাজারের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের দোকান সিটি গার্মেন্টের মালিক স্বপন রায় বলেন, 'গত বছর রোজার এ সময় তার জনা বিশেক বিক্রয়কর্মীর নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না। এবার তাদের অর্ধেক কর্মী না থাকলেও কোনো অসুবিধা হবে না।' কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে হাওর অধ্যুষিত ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার দূরত্ব যথেষ্ট। তবু ওই শহরের আনোয়ার সুপার মার্কেটের শাড়িকা নামে শাড়ির দোকানের মালিক বাবুল সাহা বলেন, 'হাওরের দুর্যোগের কারণে অন্তত ৩০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে।' নেত্রকোনার হাওর এলাকা মোহনগঞ্জে ব্যবসায়ী-নির্বিশেষে বলছেন, ঈদ উপলক্ষে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। গতকাল রোববার দুপুরে পৌর শহরের খলিফাপট্টির রোবেলের দোকানে গিয়ে দেখা গেল, সেলাই মেশিন সামনে নিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছেন তিনি। কাজ করছিলেন তার সহকারী গোলাপী বেগম। পরে আলাপে নারী ও শিশুদের কাপড় নির্মাতা রোবেল মিয়া বললেন, 'ঈদ যে আসছে, টের পাওয়া যাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.